About Me

কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত, India
আমার জন্ম ১৯৫৫ সালের ২৫ মার্চ, দক্ষিণ কলকাতার ঢাকুরিয়ায়। কিন্তু শৈশব-কৈশোর কেটেছে কখনও বাঁকুড়ায়, কখনও উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সে। ১৯৭৪-এ আমার প্রথম কবিতা লেখা - 'শত্রু যখন সমস্ত দিক ঘিরে'। আবার এ সময়ই নিকট-মানুষকে হারানোর তীব্র যন্ত্রণা থেকে লিখে ফেলি আমার প্রথম গান 'বলো ভুলতে কি পারি সাথীদের খুনে রাঙা পথ'। সময়ের অনুভবে জারিত সে সব লেখা। একটার পর একটা কবিতা বা গান লিখেছি তখন তাৎক্ষণিকের প্রয়োজনে। সেই লেখাগুলি নিয়ে আমার প্রথম কবিতার বই 'তোমার মারের পালা শেষ হলে', বার হয় ১৯৮০-তে। এর পর আমার আরও ছ'টি কবিতার বই বার হয়। আর ২০০৯ সালে, এই সাতটি বই একত্রে 'ডানা ঝাপটায় পুরনো পোস্টার' নামে কবিতা সংগ্রহরূপে প্রকাশ পায়। কবিতা লেখার পাশাপাশি গান লেখা, সুর করা আর গান গাওয়া আমার জীবনের অন্যতম অবলম্বন -অন্যতম আনন্দ। ১৯৮১ সাল থেকে 'অনুশ্রী-বিপুল' এই জুটি হিসেবে কলকাতা মহানগরী থেকে বাংলার প্রত্যন্ত প্রান্তে গান গেয়েছি - গান গেয়ে চলেছি। এ পর্যন্ত মোট সাতটি ক্যাসেট/সিডিতে সে গান প্রকাশিত। আমার গানে-কবিতায় আমি চাই সময়কে ধরতে। সময় পেরিয়ে নতুন সময়কে আবিষ্কার করতে। রিকশা চালায় যে শিশু তার অসহায়তা-বেদনাকে আমার সৃষ্টিতে যেমন ধরতে চাই তেমনি ছুঁয়ে থাকতে চাই আকাশের শেষ তারাটিকেও। জানি না সে কাজ পেরেছি কিনা - পারবো কিনা। সেই অভিমুখে - জীবনের কাছে সত্যবদ্ধ থেকে, যোগ্য শব্দ ও সুরের সন্ধানে আমার অভিযাত্রা।

Saturday, September 25, 2010

ইতিহাসবিমুখ এ সময়, বাংলা গান

আমরা এক ইতিহাসবিমুখ সময়ে বাস করছি । এই পরিপ্রেক্ষিতে গান, যা সবচেয়ে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সবচেয়ে ইতিহাসনির্ভর সবচেয়ে সমাজসম্পৃক্ত সবচেয়ে শিকড়যুক্ত সবচেয়ে দরদি মানবিকক্রিয়া সেই গান কী করে বাঁচবে এই পোড়া সময়ে !

আমরা তো বহু আগেই এমনকী আকাশকেও জুড়ে নিয়েছি আমাদের ঘর-উঠোনের সঙ্গে । নক্ষত্রে নক্ষত্রে খুঁজেছি আমাদের প্রিয়জনের মুখ । তাদের নামে নক্ষত্রের নাম রেখেছি স্বাতী, কৃত্তিকা বা অরুন্ধতী । চাঁদ আর সূর্যকে ডেকেছি চাঁদমামা আর সূয্যিমামা বলে । মানুষের বিশ্বভাতৃত্ববোধের ভিত্তির ওপর নতুন পৃথিবীর আবির্ভাবের আকাঙ্ক্ষায় আমরা তো কবে থেকেই আন্তর্জাতিক । সেক্সপিয়র, তলস্তয়, চ্যাপলিন, পিকাসো, রবসন - এঁরা তো কবেই আমাদের ঘরের মানুষ হয়ে গিয়েছেন । আর, রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি চিহ্ন নিয়েই বিশ্ববন্দিত ।

বণিকসমাজের বিশ্বায়ন কিন্তু ভুলিয়ে দিচ্ছে আমাদের শিকড়-ইতিহাসের রূপকথা । বণিকসমাজের বিশ্বায়ন কেড়ে নিচ্ছে আমাদের ভাষা । জন্ম নিচ্ছে এক বিদ্ঘুটে সঙ্কর : ও মেরে মিষ্টি বিন্দু, ওপেন দ্য জানলা ইয়ার বা হাই! আমি অভিরূপ । গানের ছত্র তৈরি হচ্ছে : বৃষ্টি ঝম্‌ঝম্‌ / বাড়িতে নেই মম্‌ / বাড়িতে নেই ড্যাড্‌ / ভাল্লাগে না, কোথায় তুই / ভাল্লাগে না, ধ্যাত্‌ / কাঁদছে সেলফোন । এরকম আরও আরও আরও । নতুন প্রজন্মের বাঙালি হারিয়ে ফেলছে তার ভাষার বিশিষ্টতাকে । তার ভাষাকে । ভাষাহীন মানুষ বোবা হয়ে যায় । গোঙানি ছাড়া তার আর কিছুই থাকে না । শুধু নদী বলা হলে নদীর কতটুকু বোঝা যায় ? জল আর পাড় । জল আর পাড় । কিন্তু যখন উচ্চারিত হয় গঙ্গা বা পদ্মা বা মিসিসিপি বা ভোল্গা, তখনই উঠে আসে তার চারপাশ । তার ভূগোল । তার ইতিহাস । তার মানে এই নয় যে আমি কোন বিশেষ ভূগোল বা ইতিহাসের দাসত্ব করতে বলছি । জীবন বহমান । জীবন ব্যাপ্ত । ছোট ছোট ঢেউ আর স্রোতেই যদি আমাদের দৃষ্টি আটকে থাকে তবে তার বিস্তৃত স্রোতস্বিনীরূপকে আমরা হারাব । কিন্তু, ঢেউ আর স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে যদি আমরা সামনের দিকে তাকাই তবে দেখব আমাদের জীবন তার আপন গরিমা নিয়ে মহাজীবনে মিশতে চলেছে এবং অববাহিকায় নতুন পলিমাটিতে কত উর্বরা ক্ষেত্রের জন্ম হচ্ছে । আধুনিকতা এই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দাবি করে ।

বাংলা গানে চখা-চখি, শুক-শারি থেকে শুরু করে লোকজীবনের যে অজস্র দৃশ্যকল্প ছড়িয়ে আছে, সুরের যে কাঠামো যে বৈশিষ্ট্য বহুকাল ধরে আছে আর তা রামপ্রসাদ, লালন, রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য আরও বহু গুনীজনকে ছুঁয়ে ক্রমে ক্রমে যে আধুনিকতায় পৌঁছেছে তাকে নষ্ট করার সবরকমের প্রচেষ্টা চলছে আজ । তৈরি হচ্ছে বিশিষ্টতার চিহ্নহীন পংক্তি বা সুর । আবারও কিছু উদাহরণ দেয়া যায় কিন্তু অহেতুক মুর্খ উচ্চারণে আর ভারাক্রান্ত করতে চাই না আমার এই নাতিদীর্ঘ লেখাটিকে । যা কিছু আজ ঘটছে তা-ই আধুনিক, এমনটা মোটেই নয় । পুরনো যুগ শেষ হয় তখনই যখন মানুষের অভিজ্ঞতায় নতুন বোধের উণ্মেষ ঘটে - মানুষের জাগ্রত চৈতন্যের প্রসার ঘটে আর তারই ফলে সমাজ সামনের দিকে এগিয়ে যায় । এই ব্যাপ্তি, এই প্রসারের অভিযানেই মানবসংস্কৃতি পরিপুষ্ট হয় । প্রাচীন পরম্পরা আত্মস্থ করেই প্রগতি । সংস্কৃতির সাধনার ক্ষেত্রে এই দায়িত্ববোধকে সচেতন রাখতে হয় যে এখানে বহু যুগের বহু প্রচেষ্টা যুক্ত হয়ে আছে এবং তাকেই ধারণ করে আছে আধুনিক কাল ।

বিশ্বায়নের বহু আগেই অবশ্য বণিকসমাজ বাংলা গানে তাদের ব্যবসায়ী থাবা বসিয়েছে । তারা জীবনের প্রতি গানের দায়বদ্ধতা কমিয়ে বাজারের প্রতি দায়বদ্ধতা বাড়িয়ে তুলেছে । তবু, জীবনের অমোঘ টানেই কখনও মীরা দেববর্মন আর শচীন দেববর্মনের লেখা ও সুর করা গানে, কখনও প্রবীর মজুমদারের লেখা ও সুর করা গানে, কখনও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের লেখা ও সুর করা গানে ঢুকে পড়েছে দেশকাল । যেমন, তোরা কে যাস রে ভাটিগাঙ বাইয়া / আমার ভাইধনরে কইও নায়র নিত আইয়া / তোরা কে যাস বা বাংলা জনম দিলা আমারে / তোমার পরাণ আমার পরাণ এক নাড়িতে বাঁধা রে / মা-পুতের এই বাঁধন ছেঁড়ার সাধ্য কারও নাই / সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল / আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল বা মাটিতে জন্ম নিলাম / মাটি তাই রক্তে মিশেছে বা তুমি রাতের সে নীরবতা দেখেছ কি / শুনেছ কি মানুষের কান্না / বাতাসে বাতাসে বাজে / তুমি শুনেছ কি

আর আছে সমাজ-সচেতন সলিল চৌধুরীর গান, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান । আরও পরবর্তী সময়ে আছে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান । যে গানে আছে দেশের জন্য ভাবনা, মানুষের জন্য ভাবনা আর আমাদের বিশিষ্টতার চিহ্ন বাংলা ভাষার জন্য ভাবনা । আছে সংগ্রামের দৃপ্ত ঘোষণা গ্রাম-নগর মাঠ-পাথার বন্দরে তৈরি হও, আছে সাধারণ গৃহবধুর বেদনাও বউ কথা কও বলে পাখি আর ডাকিস না / কী হবে কথা বলে, হৃদয়ের দুয়ার খুলে, আছে অভিশপ্ত দেশভাগের ব্যথা সোনা বন্ধু রে / আমি তোমার নাম লইয়া কান্দি, আছে হিরোশিমা ধ্বংসলীলারও সাক্ষ্য শঙ্খচিল, আছে দুঃসময়কে দেখতে পাওয়ার দূরদৃষ্টি যুগের হাওয়া অন্য মনে / জমি বেচার টাকা গোনে আর আছে সেই দুঃসময়ে দাঁড়িয়েও প্রত্যয় হাল ছেড়ো না বন্ধু । এঁদের মেধাবী গানের পাশে পাশে অজস্র মাধবীও ফুটে আছে যা প্রকৃ্ত অর্থে মূল্যবান গান কিন্তু নানা কারণে বাণিজ্য হয়ে উঠতে পারেনি বা বাণিজ্য হয়নি । সে জন্যে হয়ত তা বহু বহু মানুষের কাছে পৌঁছুতে পারেনি তবু বহু মানুষের কাছেই সে গান খুবই আদরের । এ লেখায় আমি সে আলোচনায় যেতে চাইছি না । এ প্রজন্মেও যে ব্যতিক্রম নেই, এমন নয় । আমি সে আলোচনায়ও যেতে চাইছি না । বিশ্ববাজার আজ এই সবটুকুকেই মুছে দিতে চেষ্টা করছে । ফলে, কোন ভাবনা নেই অন্বেষণ নেই । যা পাওয়া যাচ্ছে আসলে তা এক বিরাট ফাঁকি । প্রতিযোগিতার বাজারে একটু আধটু তোল্লা পেয়েই কেউ কেউ অবশ্য ধরাকে সরা ভাবছে । লাটাই থেকে কেটে যাওয়া ঘুড়ির কোনও দেশ থাকে না, আকাশও থাকে না । তা ওড়ার নামে কিছু সময় লাট খাওয়ার পর কোনও গাছের মগডালে বা কার্ণিশে আটকে যায় আর আগামীর কোনও ঝড়ে বিচূর্ণ হয় ।

জানালা দিয়ে তাকালে চতুর্দিকে অসংখ্য ফ্ল্যাটবাড়ি । সেই সব ফ্ল্যাটবাড়িতে আমাদের খুড়তুতো জ্যাঠতুতো ভাইyeরা থাকে । তারা গীটার হাতে গান করে, তালি বাজিয়ে নাচে । তাদের নাইক স্যু-এর নিচে পড়ে আছে খাল-বিল-ডোবার মানুষ, মাঠ-প্রান্তরের মানুষ যারা ফ্ল্যাট-সংস্কৃতির কাছে হেরে গিয়েছে । না কি তারা দূরে কোথাও চলে গিয়েছে ! যদি কোথাও চলে গিয়ে থাকে তো বাঁচোয়া । তাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাংলা ভাষার ইতিহাস । বাংলা গানের ইতিহাস । বাংলা গান


আমি গদ্য লিখি না । বিশেষ অনুরোধে এই গদ্য-প্রয়াস । ব্লগের বন্ধুদের জন্যে এখানে রাখলাম ।

Sunday, September 5, 2010

ময়লাগাড়ি

একটা বোটকা গন্ধ আটকে আছে


ভোর

দেখো, সদ্য ফুটে ওঠা মেয়েটি

নাকে মুখে রুমাল

এরই মধ্যে কেমন মুষড়ে পড়েছে


ওকে সইতে বলো


ওকে বলো

এই কটু গন্ধ এই ময়লাগাড়ি যত দূরেই যাক

আরও ঢের ঢের দূরে আমাদের যাওয়া


'ছেলের ঠোঁটে আকন্দের দুধ', প্রকাশকাল : জানুয়ারি ১৯৯৩

পোলট্রি

পোলট্রির ডিম ভেঙে দেখি

ভিতরে কুসুম নেই


ভয় পাই

একদিন এমন রাত্রি ঘনাবে কি

যার ভিতরে সকাল নেই


কথা ভাঙি

কবিতা কোথায়

সুর ভাঙি

কোথায় কোথায় তোর গান


'ছেলের ঠোঁটে আকন্দের দুধ', প্রকাশকাল : জানুয়ারি ১৯৯৩

দহন

মুখ নিয়ে থাক মূর্খ সময়, সে

ঝাঁপ দিয়েছে মুখর নদীতে


দশদিগন্তে কী প্রবাহ

জাপটাতে চায় ক্ষিপ্র বাহু


গাছগাছালি মাছমাছালি, কে

মন মজালি ? বাঁধতে পারবি নে


দশদিগন্তে ভীষণ দাহ

দিবারাত্রি তার বিবাহ


'ছেলের ঠোঁটে আকন্দের দুধ', প্রকাশকাল : জানুয়ারি ১৯৯৩

সৌন্দর্যের দিকে

আমার সমস্ত কান্না চলে যায় সৌন্দর্যের দিকে


এই মাটি

এখানে হাতের বেড়ি, একদিন

শাঁখা হয়ে পলা হয়ে বাজে


আমার সমস্ত কান্না চলে যাক সৌন্দর্যের দিকে


আমার সমস্ত কান্না

ভাটিয়ালি, আউল-বাউল


'ছেলের ঠোঁটে আকন্দের দুধ', প্রকাশকাল : জানুয়ারি ১৯৯৩

হে পথ হে স্বদেশ

চলার পথে পথে আমাকে ঘিরে থাকে

আলো ও আঁধারের দারুণ ভয়

যেখানে যেতে চাই, রাস্তা চিনে চিনে

সেখানে পৌঁছুতে পারব তো

চলার পথে পথে চপল সূর্যের

হঠাৎ ডুবে যাওয়া, ফের উদয়

যেখানে যেতে চাই, কোথায় যেতে চাই

এমন প্রশ্নও সঙ্গত


হে পথ হে স্বদেশ এভাবে আর নয়

এবার খুলে দাও উৎসদ্বার

তোমাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে দেখতে চাই আমি

তোমার মাটি জল মেঘমালা

এবার এসো প্রিয় ভীষণ ঝঞ্ঝায়

আমূল কাঁপে যাক আলো আঁধার

আমাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে তুমিও দেখে নাও

আমার আগ্নেয় ডালপালা


'রাত্রিজল ছুঁয়ে জেগে আছি', প্রকাশকাল : জানুয়ারি ১৯৯০

তোকে ছুঁয়ে

তোকে ছুঁয়ে এত যে আনন্দ

তুই আমার কে


কবে তোর সঁদালের রঙ

আর ঝিঁঝিঁর আঁধার

মনে লেগেছিল


আজও তা যায় না


শালে শালে সেগুনে পলাশে

তোরও কি আনন্দ বাজে

আমি কাছে এলে


ও পোড়া মাটির দেশ


'রাত্রিজল ছুঁয়ে জেগে আছি', প্রকাশকাল : জানুয়ারি ১৯৯০

আমরা

আমাদের মাথাগুলি

আমরা শিক্ষকদের কাছে পাঠিয়েছি


বিদ্বান মাথারা আর আমাদের শরীরে ফেরেনি


হাত-পাগুলি

পাঠিয়েছি মাঠে ময়দানে


হাতগুলি আগুনে পুড়েছে আর পাগুলি যে কোথায় কোথায়


'রাত্রিজল ছুঁয়ে জেগে আছি', প্রকাশকাল : জানুয়ারি ১৯৯০

ছিন্নজল, ফিরে এসো

ছিন্নজল, ভেসে আছো এ কোন্‌ আকাশে

ফিরে এসো


নিমন্ত্রণ মিছে, নক্ষত্রের


এখনও মায়ের মতো কোল পেতে আছে

নদীগুলি


ছিন্নজল, এসো, ফিরে এসো


'রাত্রিজল ছুঁয়ে জেগে আছি', প্রকাশকাল : জানুয়ারি ১৯৯০

Sunday, August 29, 2010

আমার কবিতা

ছোট ছোট আমার কবিতা


গরিবের কুঁড়ের মতন

বুকের লন্ঠন জ্বেলে সারা রাত


ছোট ছোট আমার কবিতা


তাই দিয়ে সাজাতে চেয়েছি

বর্ণময় নক্ষত্রের বিশাল আকাশ


'তোর মুখ দেখতে চাই', প্রকাশকাল : জুন ১৯৮৮

পুরনো পোস্টার

কে বলে তাদের মৃত


ভীষণ ঝড়ের রাতে গাছেরা যখন শনশন

হাওয়ায় শ্লোগান তোলে হাওয়ায় হাওয়ায়


ঝরা পাতারাও কথা বলে


ভীষণ ঝড়ের রাতে

প্রতিটি শহিদ বেদি জেগে ওঠে

ডানা ঝাপটায় ছিঁড়ে যাওয়া পুরনো পোস্টার


'তোর মুখ দেখতে চাই', প্রকাশকাল : জুন ১৯৮৮

অন্য ঠিকানা

আমি

একটি পাখির কাছে যেতে চাই


বাতাস আমাকে

বার বার নিয়ে যায় অন্য ঠিকানায়


আমি

একটি পাখির কাছে, পাখির শিসের কাছে যেতে চাই


বাতাস আমাকে নিয়ে যায়

যেখানে পাখির ভাঙা বাসা, নষ্ট ডিম, খসে যাওয়া ধূসর পালক

'তোর মুখ দেখতে চাই', প্রকাশকাল : জুন ১৯৮৮

দু-হাঁটু জড়িয়ে

নদীতে

মেয়েটির চোখের জল

আর, নদী

মেয়েটির চোখের জলে


মেয়েটি কাঁদছিল

নদীকে

তার ঘর-বন্দী জীবনের কথা বলছিল সে


নদীটিও কাঁদছিল

মেয়েটির দু-হাঁটু জড়িয়ে

সে বলছিল তার ভাসতে থাকা জীবনের কথা


নদীতে

মেয়েটির চোখের জল

আর, নদী

মেয়েটির চোখের জলে


'তোর মুখ দেখতে চাই', প্রকাশকাল : জুন ১৯৮৮

স্বদেশ

কান্নায় ভাঙতে থাকে নদী

তাকে ঘিরে, হলুদ সবুজে আঁকা বিচিত্র জ্যামিতি জুড়ে

শুনশান শব্দ তোলে অস্থির বাতাস

রক্তের ফোঁটার মতো ঝরতে থাকে পলাশ শিমুল


সৌন্দর্য রচিত হয়


অন্য কিছু রচিত হবার কথা ছিল ?

এই জিজ্ঞাসায়, রাত্রির আকাশে জাগে সপ্তর্ষিমন্ডল


'দুঃখের আঁধার রাতে, প্রিয়', প্রকাশকাল : জানুয়ারি ১৯৮৭

একটি ধূসর কবিতা

সারাদিন

আকাশে আকাশ খুঁজ়ে

ব্যর্থ

একটি পাখি

নেমে আসছে


আর

তার ক্লান্ত ডানার ছায়া

বড়, আরও বড় হতে হতে


জন্ম নিচ্ছে

একটি দীর্ঘ ধূসর কবিতা


'দুঃখের আঁধার রাতে, প্রিয়', প্রকাশকাল : জানুয়ারি ১৯৮৭

নদীর নামে নাম তার

নদীর নামে রেখেছি আমি নাম তার

চাই না তাকে শেখাতে আর চার-দেয়ালের নামতা


শেখাব তাকে নদীর মতো ছুটতে

ছোটার পথে হাজারো নদ-নদীর সাথে জুটতে


আদর করে বলব, ওরে কন্যে

এই আকাশ, উধাও মাঠ, এ সবই তোর জন্যে


ঢের হয়েছে হেঁসেল-ঘরে রান্না

হরেক গ্রাসে আটকে আছে মা-ঠাকুমার কান্না


ঢের হয়েছে, আর না


'দুঃখের আঁধার রাতে, প্রিয়', প্রকাশকাল : জানুয়ারি ১৯৮৭

আমরা চুপ হাঁটতে থাকি

আমার কিছু বলার নেই আর

তোমার যদি বলার থাকে বলো

তোমার কিছু বলার নেই আর ?

তা হলে চুপ, হাঁটতে থাকি চলো


আকাশ তার কথা বলুক আজ

খুলুক বুকে মেঘের যত ভাঁজ


আমরা চুপ হাঁটতে থাকি চলো


'দুঃখের আঁধার রাতে, প্রিয়', প্রকাশকাল : জানুয়ারি ১৯৮৭

Saturday, August 28, 2010

নীল পাহাড়ের দেশে

যেদিকে ইচ্ছে তোর সেদিকে তাকাস

চিমনি, টাওয়ার নেই

ধোঁয়ার পাহাড় নেই

আকাশ আকাশ শুধু আকাশ আকাশ


যেদিকে ইচ্ছে, ঘাড় সেদিকে বাঁকাস

টেলিগ্রাফ-তার নেই

'টাটা সেন্টার' নেই

আকাশ আকাশ শুধু আকাশ আকাশ


হাওয়ায় হাওয়ায়

টিয়ার ঝাঁকের মতো সবুজ ধানের দেশ

উড়ে যেতে চায়


রুদ্ধ ডানার সেই ছটফটানি

শুনেছি কোথায় যেন

শুনেছি আমি


'দে ছাইড়ে দে

লাজ লাইগছে

সইরে দাঁড়া

সর না' -


পাথরটিকে

পাশ কাটিয়ে

পালায় ছুটে

ঝরনা


'চললি কোথায়'

পাহাড় শুধোয়

নদীকে

ছুটতে ছুটতে

নদী বলে, 'যাই

ওদিকে...'


সোনার ডালিম বুকে

কী গভীর প্রেম-সুখে

কাঁপে তার হৃদয়ের ডাল


নীল পাহাড়ের কোলে

নীল ঝরনার জলে

স্নান করে কিশোরী সকাল


চোখ-দুটি কী যে বলে

ভুরু-দুটি বাঁকিয়ে

ঠোঁট-দুটি কী যে চায়

ঠোঁটপানে তাকিয়ে


ফুলের গন্ধে

বনে বনে বুঝি

বাতাসেরা এসে জোটে


না কি বাতাসের

পেছনেই সব

ফুলের গন্ধ ছোটে


সোহাগ ছড়ানো ভাদরে

মাচায় লুটায় ডিংলার ফুল

ভ্রমরের চুমা-আদরে


ও মেয়ে, বাপের ঘরে এসে তবু

কার লাগি তুই কাঁদো রে


আহা, কালো মেয়ে, আকাশের কালো মেঘ তুই

তোর বাঁকা দু-চোখের বিদ্যুৎ ইশারায়

আমি পোড়া মাটি, এত কাল পুড়েছি শুধুই

আজ বুক জুড়ে কী ভীষণ ঝড় বয়ে যায়


আহা, কালো মেয়ে, আকাশের কালো মেঘ তুই

আয় বুকে আয় বৃষ্টির ফোঁটায় ফোঁটায়


১০

বারান্দাতে

ঝিমোচ্ছিলাম

বুকের ভেতর

নিঝুম দুপুর


হঠাৎ শুনি

আমরা এলাম -

টাপুর টুপুর

টাপুর টুপুর...


১১

তুমি দেখো নীল তোমার চোখের পদ্ম

আমার চোখের হ্রদে


আর, আমি দেখি আমার মাতাল দুই চোখ

তোমার চোখের মদে


১২

চারদিক ভরে

গেছে হৃদয়ের

ঘ্রাণে

কিছুতেই ঢাকা

যায় না রে আর

যৌবন


ডাকাত ভ্রমর

বুকের বসন

টানে

দুপুরের রোদে

লজ্জায় কাঁপে

মৌ-বন


১৩

গাঁয়ের মোড়লের

ছেলেরা সুন্দর

ও মেয়ে, কাছে তুই

যাস নে তা বলে


রঙিন চামড়ার

সাপেরা সুন্দর

কিন্তু বিষ ভরা

ছোবলে ছোবলে


১৪

নীল পাহাড়ি

লাল পলাশ

বোবাকে তুই

কথা বলাস

১৫

অস্তাচলের সূর্য চুম্বন আঁকে তার ঠোঁটে

বলে, 'ফের দেখা হবে কাল'


ম্লান, তবু লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে

সুন্দরী পাহাড়ি বিকাল


১৬

মাদল বাজে

দূরে

মাদল বাজে

কাছে


'দাদারিয়া'র

সুরে

নাচে পাহাড়

নাচে


১৭

বনে আগুন লাগল, প্রিয়

সবার চোখে পড়ল তা

মনে আগুন লাগল, প্রিয়

কারুর চোখে পড়ল না


কাকে জানাই, কাকে জানাই

শরীর পুড়ে হচ্ছে ছাই


একটি অসমিয়া লোকগীতি অনুসরণে


১৮

আকাশে চাঁদ

টলছে

নদীতে চাঁদ

টলছে


আমি সোজাই হাঁটছি

তবু

লোকে মাতাল

বলছে


১৯

আহা, রাত সুন্দর! আর তারও চেয়ে

সুন্দর তুই, ওগো সাঁওতাল মেয়ে


তারা উজ্জ্বল, যত উজ্জ্বলই হোক

তারও চেয়ে উজ্জ্বল তোর দুটি চোখ


আর, তোর পাহাড়িয়া সাঁওতাল-মন

জ্যোৎস্না ছড়ানো গোল চাঁদের মতন


২০

ঐ দূরে

সবুজ ধানের দেশে


সেখানে যেতেই


ঐ দূরে

রুপালি নদীটি ঘেঁষে


সেখানে যেতেই


ঐ দূরে

নীল পাহাড়ের দেশে


সেখানে যেতেই


ঐ দূরে...


'নীল পাহাড়ের দেশে', প্রকাশকাল : অগস্ট ১৯৮৫