আমরা এক ইতিহাসবিমুখ সময়ে বাস করছি । এই পরিপ্রেক্ষিতে গান, যা সবচেয়ে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য সবচেয়ে ইতিহাসনির্ভর সবচেয়ে সমাজসম্পৃক্ত সবচেয়ে শিকড়যুক্ত সবচেয়ে দরদি মানবিকক্রিয়া – সেই গান কী করে বাঁচবে এই পোড়া সময়ে !
আমরা তো বহু আগেই এমনকী আকাশকেও জুড়ে নিয়েছি আমাদের ঘর-উঠোনের সঙ্গে । নক্ষত্রে নক্ষত্রে খুঁজেছি আমাদের প্রিয়জনের মুখ । তাদের নামে নক্ষত্রের নাম রেখেছি স্বাতী, কৃত্তিকা বা অরুন্ধতী । চাঁদ আর সূর্যকে ডেকেছি চাঁদমামা আর সূয্যিমামা বলে । মানুষের বিশ্বভাতৃত্ববোধের ভিত্তির ওপর নতুন পৃথিবীর আবির্ভাবের আকাঙ্ক্ষায় আমরা তো কবে থেকেই আন্তর্জাতিক । সেক্সপিয়র, তলস্তয়, চ্যাপলিন, পিকাসো, রবসন - এঁরা তো কবেই আমাদের ঘরের মানুষ হয়ে গিয়েছেন । আর, রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ চিহ্ন নিয়েই বিশ্ববন্দিত ।
বণিকসমাজের বিশ্বায়ন কিন্তু ভুলিয়ে দিচ্ছে আমাদের শিকড়-ইতিহাসের রূপকথা । বণিকসমাজের বিশ্বায়ন কেড়ে নিচ্ছে আমাদের ভাষা । জন্ম নিচ্ছে এক বিদ্ঘুটে সঙ্কর : ‘ও মেরে মিষ্টি বিন্দু’, ‘ওপেন দ্য জানলা ইয়ার’ বা ‘হাই! আমি অভিরূপ’ । গানের ছত্র তৈরি হচ্ছে : ‘বৃষ্টি ঝম্ঝম্ / বাড়িতে নেই মম্ / বাড়িতে নেই ড্যাড্ / ভাল্লাগে না, কোথায় তুই / ভাল্লাগে না, ধ্যাত্ / কাঁদছে সেলফোন’ । এরকম আরও আরও আরও । নতুন প্রজন্মের বাঙালি হারিয়ে ফেলছে তার ভাষার বিশিষ্টতাকে । তার ভাষাকে । ভাষাহীন মানুষ বোবা হয়ে যায় । গোঙানি ছাড়া তার আর কিছুই থাকে না । শুধু নদী বলা হলে নদীর কতটুকু বোঝা যায় ? জল আর পাড় । জল আর পাড় । কিন্তু যখন উচ্চারিত হয় গঙ্গা বা পদ্মা বা মিসিসিপি বা ভোল্গা, তখনই উঠে আসে তার চারপাশ । তার ভূগোল । তার ইতিহাস । তার মানে এই নয় যে আমি কোন বিশেষ ভূগোল বা ইতিহাসের দাসত্ব করতে বলছি । জীবন বহমান । জীবন ব্যাপ্ত । ছোট ছোট ঢেউ আর স্রোতেই যদি আমাদের দৃষ্টি আটকে থাকে তবে তার বিস্তৃত স্রোতস্বিনীরূপকে আমরা হারাব । কিন্তু, ঢেউ আর স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে যদি আমরা সামনের দিকে তাকাই তবে দেখব আমাদের জীবন তার আপন গরিমা নিয়ে মহাজীবনে মিশতে চলেছে এবং অববাহিকায় নতুন পলিমাটিতে কত উর্বরা ক্ষেত্রের জন্ম হচ্ছে । আধুনিকতা এই সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি দাবি করে ।
বাংলা গানে চখা-চখি, শুক-শারি থেকে শুরু করে লোকজীবনের যে অজস্র দৃশ্যকল্প ছড়িয়ে আছে, সুরের যে কাঠামো যে বৈশিষ্ট্য বহুকাল ধরে আছে আর তা রামপ্রসাদ, লালন, রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য আরও বহু গুনীজনকে ছুঁয়ে ক্রমে ক্রমে যে আধুনিকতায় পৌঁছেছে তাকে নষ্ট করার সবরকমের প্রচেষ্টা চলছে আজ । তৈরি হচ্ছে বিশিষ্টতার চিহ্নহীন পংক্তি বা সুর । আবারও কিছু উদাহরণ দেয়া যায় কিন্তু অহেতুক মুর্খ উচ্চারণে আর ভারাক্রান্ত করতে চাই না আমার এই নাতিদীর্ঘ লেখাটিকে । যা কিছু আজ ঘটছে তা-ই আধুনিক, এমনটা মোটেই নয় । পুরনো যুগ শেষ হয় তখনই যখন মানুষের অভিজ্ঞতায় নতুন বোধের উণ্মেষ ঘটে - মানুষের জাগ্রত চৈতন্যের প্রসার ঘটে আর তারই ফলে সমাজ সামনের দিকে এগিয়ে যায় । এই ব্যাপ্তি, এই প্রসারের অভিযানেই মানবসংস্কৃতি পরিপুষ্ট হয় । প্রাচীন পরম্পরা আত্মস্থ করেই প্রগতি । সংস্কৃতির সাধনার ক্ষেত্রে এই দায়িত্ববোধকে সচেতন রাখতে হয় যে এখানে বহু যুগের বহু প্রচেষ্টা যুক্ত হয়ে আছে এবং তাকেই ধারণ করে আছে আধুনিক কাল ।
বিশ্বায়নের বহু আগেই অবশ্য বণিকসমাজ বাংলা গানে তাদের ব্যবসায়ী থাবা বসিয়েছে । তারা জীবনের প্রতি গানের দায়বদ্ধতা কমিয়ে বাজারের প্রতি দায়বদ্ধতা বাড়িয়ে তুলেছে । তবু, জীবনের অমোঘ টানেই কখনও মীরা দেববর্মন আর শচীন দেববর্মনের লেখা ও সুর করা গানে, কখনও প্রবীর মজুমদারের লেখা ও সুর করা গানে, কখনও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের লেখা ও সুর করা গানে ঢুকে পড়েছে দেশকাল । যেমন, ‘তোরা কে যাস রে ভাটিগাঙ বাইয়া / আমার ভাইধনরে কইও নায়র নিত আইয়া / তোরা কে যাস’ বা ‘বাংলা জনম দিলা আমারে / তোমার পরাণ আমার পরাণ এক নাড়িতে বাঁধা রে / মা-পুতের এই বাঁধন ছেঁড়ার সাধ্য কারও নাই / সব ভুলে যাই তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল / আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’ বা ‘মাটিতে জন্ম নিলাম / মাটি তাই রক্তে মিশেছে’ বা ‘তুমি রাতের সে নীরবতা দেখেছ কি / শুনেছ কি মানুষের কান্না / বাতাসে বাতাসে বাজে / তুমি শুনেছ কি’।
আর আছে সমাজ-সচেতন সলিল চৌধুরীর গান, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের গান । আরও পরবর্তী সময়ে আছে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান । যে গানে আছে দেশের জন্য ভাবনা, মানুষের জন্য ভাবনা আর আমাদের বিশিষ্টতার চিহ্ন বাংলা ভাষার জন্য ভাবনা । আছে সংগ্রামের দৃপ্ত ঘোষণা ‘গ্রাম-নগর মাঠ-পাথার বন্দরে তৈরি হও’, আছে সাধারণ গৃহবধুর বেদনাও ‘বউ কথা কও বলে পাখি আর ডাকিস না / কী হবে কথা বলে, হৃদয়ের দুয়ার খুলে’, আছে অভিশপ্ত দেশভাগের ব্যথা ‘সোনা বন্ধু রে / আমি তোমার নাম লইয়া কান্দি’, আছে হিরোশিমা ধ্বংসলীলারও সাক্ষ্য ‘শঙ্খচিল’, আছে দুঃসময়কে দেখতে পাওয়ার দূরদৃষ্টি ‘যুগের হাওয়া অন্য মনে / জমি বেচার টাকা গোনে’ আর আছে সেই দুঃসময়ে দাঁড়িয়েও প্রত্যয় ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’ । এঁদের মেধাবী গানের পাশে পাশে অজস্র মাধবীও ফুটে আছে যা প্রকৃ্ত অর্থে মূল্যবান গান কিন্তু নানা কারণে বাণিজ্য হয়ে উঠতে পারেনি বা বাণিজ্য হয়নি । সে জন্যে হয়ত তা বহু বহু মানুষের কাছে পৌঁছুতে পারেনি তবু বহু মানুষের কাছেই সে গান খুবই আদরের । এ লেখায় আমি সে আলোচনায় যেতে চাইছি না । এ প্রজন্মেও যে ব্যতিক্রম নেই, এমন নয় । আমি সে আলোচনায়ও যেতে চাইছি না । বিশ্ববাজার আজ এই সবটুকুকেই মুছে দিতে চেষ্টা করছে । ফলে, কোন ভাবনা নেই অন্বেষণ নেই । যা পাওয়া যাচ্ছে আসলে তা এক বিরাট ফাঁকি । প্রতিযোগিতার বাজারে একটু আধটু ‘তোল্লা” পেয়েই কেউ কেউ অবশ্য ধরাকে সরা ভাবছে । লাটাই থেকে কেটে যাওয়া ঘুড়ির কোনও দেশ থাকে না, আকাশও থাকে না । তা ওড়ার নামে কিছু সময় লাট খাওয়ার পর কোনও গাছের মগডালে বা কার্ণিশে আটকে যায় আর আগামীর কোনও ঝড়ে বিচূর্ণ হয় ।
জানালা দিয়ে তাকালে চতুর্দিকে অসংখ্য ফ্ল্যাটবাড়ি । সেই সব ফ্ল্যাটবাড়িতে আমাদের খুড়তুতো জ্যাঠতুতো ভাইyeরা থাকে । তারা গীটার হাতে গান করে, তালি বাজিয়ে নাচে । তাদের নাইক স্যু-এর নিচে পড়ে আছে খাল-বিল-ডোবার মানুষ, মাঠ-প্রান্তরের মানুষ যারা ফ্ল্যাট-সংস্কৃতির কাছে হেরে গিয়েছে । না কি তারা দূরে কোথাও চলে গিয়েছে ! যদি কোথাও চলে গিয়ে থাকে তো বাঁচোয়া । তাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাংলা ভাষার ইতিহাস । বাংলা গানের ইতিহাস । বাংলা গান
আমি গদ্য লিখি না । বিশেষ অনুরোধে এই গদ্য-প্রয়াস । ব্লগের বন্ধুদের জন্যে এখানে রাখলাম ।