ছেলেবেলায় একবার বাবার সঙ্গে বেরিয়ে, মাঠের মধ্য দিয়ে পথ হাঁটতে হাঁটতে অকারণে জিজ্ঞেস করেছিলাম- আমরা কোথায় যাচ্ছি, বাবা? বাবা বলেছিলেন- ওই দূরে। -- ওই দূরে মানে কত দূরে? -- ওই দূরে মানে ও-ও-ওই দূরে। আর কিছু না বলে, চোখ চেয়ে দেখেছিলাম, সামনে শুধু মাঠ আর মাঠ আর মাঠ। মাঠে মাঠে বাতাসের স্বরে বহে যাওয়া ফসলের কান্না। আর তারও পরে, দূরের আকাশে একটি তারা মিটমিট করে জ্বলছে। এসবের মাঝে কেমন যেন ভয় হয়েছিল। শিউরে উঠে বাবাকে বলেছিলাম- না না, আমি যাব না। এখনই বাড়ি ফিরে চল। -- আচ্ছা বেশ, তা-ই চল। আজ এই অবধিই থাক। আরেকদিন, না হয় আরেকদিন যাওয়া যাবে।
তারপর একদিন বাবা চলে গেলেন। একা একা। আমাকে সঙ্গে নেননি। বলেও যাননি কিছু।
বন্ধুদের সঙ্গে, এরপর, কবে যে মেলালাম নিজেকে। কীভাবে যে মেলালাম। বন্ধুরা একসঙ্গে কতবার মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে যেতে যেতে গান গেয়েছি - 'আর দূর নেই দিগন্তের আর দূর নেই।' সবাই মিলে থাকায় এই উচ্চারণে ভয় হয়নি একটুও। ফসলের স্বরকেও এ সময় মনে হয়েছে আমাদের সঙ্গে, গান গাইছে। কিন্তু বাবাকে মনে পড়তেই চোখ চেয়ে দেখেছি দূরে, তেমনিii দূরেই সেই আকাশ আর সেই তারা মিটমিট করে জ্বলছে।
দিনগুলি গড়িয়ে চলেছে। আমাদের কত যে গল্প, কত কথা, আমাদের গাওয়া গানগুলি গড়িয়ে চলেছে।
আজ, সন্তানের হাত ধরে পথ হাঁটতে হাঁটতে এই ভুবনডাঙ্গার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ভাবি, সে যদি জিজ্ঞেস করে কোথায় যাচ্ছি আমরা, কী বলব তাকে? বলব কি ওই দূরে ওই তারাটির কাছে! আমার বাবা কি আমাকে সে কথাই বলতে চেয়েছিলেন! তিনি কি সত্যিই ওই তারাটির কাছে এতদিনে পৌঁছে গিয়েছেন! বন্ধুরাই বা কী বলতে চেয়েছে গানে গানে, কী বলতে চায়! আমার সন্তানকে কী বলব? আমার বাবার মত একা-একাই সেখানে যেতে হয়, নাকি বন্ধুরা মিলে সবাই মিলে একদিন সেখানে যেতে হবে! যেতে হবে একটি তারাকে পেরিয়ে আরও আরও তারার দিকে!
দূরে, তেমনি দূরেই সেই আকাশ আর সেই তারা মিটমিট করে জ্বলছে।
প্রকাশ : 'ছাতিমতলা', সংকলন-১৮, কার্তিক ১৪০০, অক্টোবর ১৯৯৩